মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০১:০৫ অপরাহ্ন

রেললাইনের ধারে বস্তিতে ভুমিহীন মুক্তিযোদ্ধার ঠাঁই

লালমনিরহাট প্রতিনিধি::

স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরেও বাস্তুহারা মুক্তিযোদ্ধার পরিবারটি। দির্ঘদিন যুদ্ধ করে আজ জীবন যুদ্ধে পরাজিত ভূমিহীন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজ্জামেল। বর্তমানে তার ঠাঁই এখন রেল লাইনের ধারে গড়ে উঠা বস্তিতে। সরকার ঘোষিত মুক্তিযোদ্ধার নামে বরাদ্দকৃত বাড়ি তার ভাগ্যে জোটেনি। বীরমুক্তিযোদ্ধা মোজ্জাম্মেল হক(৭০)। জীবনযুদ্ধে পরাজিত একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর ভারতীয় তালিকা নং ৪৩৩৯৫, লালমুক্তিবার্তা নং ৩১৪০২০০৮০ ও বেসামরিক গেজেট নম্বর ৬৭৪। মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল পিতা মাতার একমাত্র সন্তান। তার পিতা ছিলেন রেলওয়ের একজন কর্মচারি। পিতার নাম মৃত সেনার উদ্দিন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় সখের বশে বিয়ে দিয়েছিলেন ছেলে মোজাম্মেলকে। বিয়ের ছয় মাস পরে নব পরিণীতা স্ত্রীরকে কিছু একটা কিনে দিবে এই চিন্তা মাথায় নিয়ে সকাল ১০ টায় জেলার হাতীবান্ধা রেলওয়ে স্টেশন বাজারে যায়। এই সময় ট্রেনযোগে পাকিস্তানী সেনারা স্টেশনে নামেন। তখন অনেকে পাকিস্তানী পতাকা হাতে নিয়ে মিছিল করে তাদের স্বাগত জানান। এসময় পাকিস্তানি সেনারা হাতীবান্ধা থানায় প্রবেশ করে থানার সকল অস্ত্র জব্দ করে নিয়ে যায়। ফেরার পথে ষ্টেশনে পাকিস্তানী সেনাদের নজরে পড়ে যায়। তাঁকে মুক্তিবাহিনী মনে করে পাকিস্তানি সেনারা ধরে নিয়ে একটি ওয়াগনে তুলে। সেখানে তার চোখ বেঁধে ফেলা হয়। তখন তিনি অনুভব করেন এই ওয়াগনে অনেককে মুক্তিবাহিনী হিসেবে ধরে নিয়ে এসেছে। দিনভব চলে সেখানে তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন। সেখান থেকে অনেককে কোথায় যেন নিয়ে যাওয়া হয়। তারা আর ফিরে আসেনি। তার পালা এলে তাকেও নিয়ে যেতে আসেন এক অবাঙ্গালি রেল পুলিশ। বাবার চাকুরির সুবাদে তিনি তার ছিলেন, পূর্ব পরিচিত। তাকে আংকেল বলে ডাকলে তিনি তাকে চিনে ফেলে এবং পাকিস্তানিদের বলেন সে মুক্তি নেহি হায়। সাচ্চা মুসলমান আদমি হায়। বলে তাকে ছেড়ে দেয়। তিনি রেলের ওই ওয়াগানে প্রথম মুক্তিবাহিনীর কথা শুনে। তার আগে সে কখনও মুক্তিযুদ্ধে যাবে ভাবেনি। এক বাবার একমাত্র ছেলে হওয়ায় অনেক আদরে মানুষ হয়ে ছিলেন। বাবার সরকারি চাকুরি। ভালই চলছিল। বিয়ে করে স্ত্রীকে নিয়ে স্বপ্নে বিভর ছিলেন। কিন্তু স্বপ্নে ছেদ পড়ে স্ত্রীর জন্য কিছু কিনতে গিয়ে। তার ওপর নির্যাতনের ফলে ঠিকমত দাঁড়াতে পারেনি।

জীবন বাঁচাতে পাশের জঙ্গলে গিয়ে সারারাত শুয়ে ছিলেন। পর দিন ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেলে সীদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। তার ওপর নির্যাতন ও তার গালে থাপ্পােরের প্রতিশোধ নিবেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে যাবেন। যে চিন্তা সেই কাজ। মুহুর্তে স্ত্রী বাবা মায়ের কথা ভুলে সীমান্ত পারি দিয়ে ভারতে চলে যান। সেখানে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে অস্ত্র হাতে ৯ মাস সম্মুখ যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেন। তিনি জানতেও পারিনি স্ত্রী, বাবা ও মা বেঁচে আছে না মরে গিয়ে ছিল। স্বাধীনতার পর ফিরে এসে সব ফিরে পান। বাবা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পরেছিল। তার চিকিৎসা করাতে সব বিক্রি করতে হয়ে পরিবারটি নিঃস্ব হয়ে যায়। বসতভিটা দখলে নেয় প্রভাবশালি একটি মহল। ফলে কষ্টে পড়ে যায় তার পরিবার। রেলওয়ের পোষকোটায় ও মুক্তিযুদ্ধা কোটায় অনেক জায়গায় একটি কাজের জন্য আবেদন করেও কাজ মেলেনি। মেলেনি কোন কর্মসংস্থান। পরে জীবন বাঁচাতে বড়খাতা রেলওয়ে গেট বাজারে নৈশ্যপ্রহরীর চাকরি করতে বাধ্য হয়। এই নাইট গার্ডের কাজ করে মাসে মাত্র ৩শত টাকা আয় হতো। সব শেষ মাসিক আয় ছিল ১২শত টাকা। এভাবে প্রায় ৪০ বছর নৈশ্যপ্রহরীর কাজ করেন। এই আয়ে তার পরিবারের সদস্যদের ঠিকমতো পেটের ভাত জুটতো না। তাই আশ্রয় হয় রেলওয়ে গেট সংলগ্ন রেললাইনের ধারে রেলওয়ের জমিতে। দেড়/ দুই শতক জমির ওপর দুইটি ঝুপরি তুলে বসবাস করতে থাকেন।

এভাবেই চলছিল তার জিবন যুদ্ধ। সংসার জিবনে তার এক মেয়ে ও এক ছেলে আছে। তাদের বিয়ে দিয়েছেন। আর্থিক অনটনের কারণে সন্তানদের লেখা পড়া করাতে পারেনি। ছেলে ছোট একটি পানের দোকান দিয়ে সংসারের হাল ধরেছেন। এরমধ্যে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার ক্ষমতায় এলে ২০০০ সালে হাতীবান্ধায় ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে মাত্র ৩শত টাকা করে ভাতা দেয়। তাদের মধ্যে তিনি একজন। এই ভাতা পেয়ে সকলে জেনে যায় তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ফলে তাকে দিয়ে কেউ আর নৈশ্যপ্রহরীর কাজ করাতে চায়না। আবার পড়ে যান আর্থিক কষ্টে। তার ছেলের পানের দোকানে সময় দিতে শুরু করেন। এভাবে চলছিল তার দিন।

বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষের সরকার প্রতিমাসে ১২ হাজার টাকা আর্থিক অনুদান দিচ্ছেন। তাই দিয়ে কোন ভাবে সংসার চলছে। এখন বৃদ্ধ বয়সে নানা রোগে পেয়ে বসেছে। ঔষধ কিনতে এই অর্থ শেষ। তার ওপর কনকনে ঠান্ডায় রাতে ঘুমাতে পারেনা। রেললাইনের ধারে ভাঙ্গা ঝুপরি ঘরে রাতে হুহু করে বাতাস আসে। ট্রেন এলে শব্দে ও ধুলায় দমবন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়ে যায়। এজন্যই সরকারের কাছে একটি বাড়ি সহায়তা চায় এই মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল, চায় চিকিৎসা সহায়তা। এই ভুমিহীন মুক্তিযোদ্ধার একশতাংশ জমি নেই। তাই সরকার ঘোষিত মুক্তিযোদ্ধাদের গৃহনির্মাণ প্রকল্পের ঘর তার কপালে জোটেনি। কখনো জুটবে কিনা এই হতাশা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। মৃত্যুর আগে তার সন্তান, নাতি, নাতনিকে একটু আশ্রয় দেখে যেতে চায়।

মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল বলেন, এই মুক্তিযোদ্ধার আক্ষেপ যে দেশের ভূ-খন্ডকে স্বাধীন করতে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করলাম সেই দেশে আমার নামে একশতাংশ জমিও নেই। আমি স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও আশ্রয়হীন, ভুমিহীন, বাস্তুহারা, সরর্বহারা। নাতি নাতনিরা বড় হয়েছে। তারা বলেন, দাদা তুমি না মুক্তিযোদ্ধা। বিজয় দিবস, স্বাধিনতা দিবস কত দিবস পালন হয়, কতো সাজসজ্জায় সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করে। মন্ত্রী এমপিরা আসে। তোমাদের নিয়ে বত্তব্য দেয়, গর্ব করে। কিন্তু তোমাকে নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারিনা কেন? আমাদের ঘর নেই কেন? পেটপুড়ে খাবার পাইনা কেন? তুমি অসুস্থ হলে চিকিৎসা করাতে পারিনা কেন? এই অবুজ নাতি নাতনিদের প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারিনা। শুধু চোখের জল ফেলি।

হাতীবান্ধা উপজেলা প্রশাসনের জনৈক কর্মকর্তা জানান, বীর মুক্তিযোদ্ধার বসতভিটা তৈরী করে দেবেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে কথা এই বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা প্রায় প্রতিদিন এসে খবর নেন। খোঁজ নিতে আসেন তার নামে কোন বাড়ি বরাদ্ধ হয়েছে কিনা? কিন্তু তাকে শান্তনা দিয়ে পাঠিয়ে দেই। কিছুই করার থাকেনা। তার বসতবাড়ি নির্মানের কোন জমি নেই। রেলওয়ে জমিতে বাড়ি করে দেয়ার বিধান নেই। স্বাধীনতার ৫০ বছর এবছর উদযাপন করা হবে। মুক্তিযোদ্ধাগণ যেন, কোন গৃহহীন না থাকে তার দিকে স্বাধীনতার স্বপক্ষের সরকার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকারের বিষয়টি ভাবতে হবে।

হাতীবান্ধা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সামীউল আমীন জানান, মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেলের বিষয়টি খোঁজ খবর নিতে শুরু করা হয়েছে। এই ভুমিহীন মুক্তিযোদ্ধাকে খাসজমি বরাদ্দ দিয়ে বাড়ি করে দেয়ার ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com